বসন্তের রঙে

নবাবজাদা এতক্ষণে সময় হল তোর আসার? এতক্ষণ সময় কি করেছিস? নিশ্চয়  বখাটেদের সাথে নেশাভান করে এসেছিস? চেহারাটাও তো দিন দিন নেশাখোরের মত হয়ে যাচ্ছে। 

 বসন্তের মামী চাঁপা বেগমের কথা শুনে পাশ থেকে তার মেয়ে খুকি বলে উঠে, সে তুমি বড় ভাইয়াকে খেতে দাও না বলে অমন হচ্ছে। 

চাঁপা বেগম রাগে ঘাড় ঘুড়িয়ে বলে, তুই চুপ কর খুকি। কতবার বলেছি আমার মুখের উপর কথা বলবি না। 

বসন্ত বাজারের ব্যাগ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর থেকে ঘাম ঝড়ে পরছে। চাঁপা বেগম হাত থেকে ব্যাগটা টান দিয়ে আবার বলা শুরু করেছে, আপদ এসে আমার ঘাড়েই জুটেছে। নিজের বাপ মাকে খেয়েছে এখন আমার সংসার খেতে এসেছে। নামটাও মিলেছে তার সাথে। বসন্ত। রোগ বালাইয়ের মতই আমার সংসারে এঁটে আছে। 

বসন্তের মামা চাঁপা বেগমকে থামিয়ে বলে, আহা ছেলেটাকে অযথা বকছো কেন? ও তো ঠিক সময়েই এসেছে। আর তার নাম বসন্ত মানে জলবসন্ত, গুটিবসন্ত না। বসন্ত মানে বসন্ত কাল। কোকিলের গানে, ফুলে ফুলে যখন.....

চুপ করো ভাগ্নের হয়ে সাফাই গাইতে এসো না। আমাকে নাম শেখাচ্ছে। কোকিলের গান না কাকের গান তা ভালো জানা আছে। 

বসন্তের দিকে তাকিয়ে বলে, তাকিয়ে দেখছিস কি হারামজাদা? যা রান্নাঘরে এঁটো বাসন গুলো মেজে ফেল। 

খুকি বলে, ছেলে মানুষ আবার বাসন মাজে নাকি? 

খুকি মাথা গরম করবি না আমার বলে দিলাম। মুখে কিন্তু গরম খুন্তি গুঁজে দেব। 

এই বলে চাঁপা বেগম চলে যায়। খুকি মাথা নিচু করে চলে যায়। হতভাগা স্বামী তার স্ত্রীকে মানাতে না পেরে সেও চলে যায়। আর বসন্ত নিশ্চুপ হয়ে বাসন মাজতে চলে যায়। চোখ মুছতে মুছতে বাসন মাজতে থাকে। মামীকে যে বলবে তার ক্ষিদে পেয়েছে সেই উপায়ও তো নেই। মাঝে মাঝে তার মন চায় সব ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু কোথায় আর যাবে? যাওয়ার জায়গা কি আছে তার? 

বসন্তের যখন চার বছর বয়স তখন তার বাবা মা রোড এক্সিডেন্টে মা*রা যায়। এরপর তার মামা তাকে মামার বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রথম প্রথম তার মামী ভালোবাসলেও পরে সহ্যই করতে পারে না। চাঁপা বেগমের তিন সন্তান। বড় ২ ছেলে আর এক মেয়ে খুকি সবার ছোট। বসন্ত তাদের তিনজনেরই বড়। বাবা মা চলে যাওয়ার পর থেকে বসন্তকে সহ্য করতে পারে না চাঁপা বেগম। অবশ্য এতে চাঁপা বেগমের মায়ের কুমন্ত্রণা আছে। তার মামা সরল হওয়ায় চাইলেও তার মামীকে বাঁধা দিতে পারে না। মামীর অত্যাচার সইতে সইতেই তার দিন পার হচ্ছে। 

রাতে তার মামা এসে বলে, বাবারে আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস। তোর এই হতভাগা মামা তোর জন্য কিছুই করতে পারে না। তোর মায়ের কাছে আমি কি জবাব দেবো বলতো?

বসন্ত বলে, মামা এসব বলো না। তোমরা না থাকলে আমার কি হতো বলতো! তুমি মামী আর খুকিই তো আমার সব। মামী তো মায়ের মত। মা বকলে কিছু হয় না। 

তার মামা ছলছল চোখে বলে, তুই একদম তো মায়ের মত হয়েছিস। মন দিয়ে পড় সামনে তো তোর পরীক্ষা। পড়াশোনা করে অনেক বড় হতে হবে তো।

মামা চলে যাওয়ার পর বসন্ত পড়তে বসে। চোখ গুলো পানিতে ভরে উঠে। টপটপ করে চোখের পানি পড়ে বইয়ের পাতায়। কষ্ট তার গলা চেপে ধরেছে। মা বাবার কথা প্রচন্ড রকমে মনে পরছে। মনে পরছে সেই দিনগুলোর কথা। আগে মামী তাকে কত আদর করত। কিন্তু এখানে একেবারে আসার  পর তার সব আদর উবে গেল। মনে মনে বলল, কেন যে মা বাবার সাথে সেও চলে গেল না। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেন তাকে একা করে চলে গেল?

দুপুরের কড়া রোদে কলেজ থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছে বসন্ত। তার পেটে যেন ক্ষুদার রাজ্য। কিন্তু সে খুব ভালো করে জানে বাড়ি গেলে সে ভাত নাও পেতে পারে। ঘাম মুছতে মুছতে বাড়িতে গিয়ে উঠল। গোসল সেরে মামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বলে, যান নবাবজাদা  গিলে আমায় উদ্ধার করুন। 

বসন্ত সোজা রান্না ঘরে যায়। দেখে ভাতের পাতিলের তলায় দু মুঠো ভাত পরে আছে। আর তরকারির পাতিলে ঝোল আর গুটিকয়েক আলু পরে আছে। তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। তবুও এগুলোই গোগ্রাসে  খেতে শুরু করে। পেছন থেকে তেরো বছরের খুকি ভাত আর মাংস নিয়ে হাজির। বসন্ত বলে, খুকি তুই খাস নি? 

খেয়েছি বড় ভাইয়া। আমি আর বাবা আমাদের ভাগ থেকে তোমার জন্য রেখেছি। এখন নাও তো খেয়ে নাও। 

পাকা বুড়ি একটা। এত পাকামি করতে কে বলেছে শুনি?

খুকি চোখ পাকিয়ে বলে, বুঝেছি তুমি খাবে না। 

এই বলে সে বসন্তকে খায়িয়ে দিতে থাকে। বসন্ত বলে দেখিস খুকি যখন আমার চাকরি হবে তখন তোর সব আবদার পূরণ করব। তুই যা চাইবি তোকে তাই কিনে দেব। 

খুকি মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ায়।

 বসন্তের মামা চাঁপা বেগমকে বোঝানোর স্বরে বলে, আচ্ছা তুমি কি ভুলে গেছো বসন্তের বাবা মা থাকাকালীন তুমি ওকে ১ বছর তোমার এখানে রেখেছিলে তোমার বাচ্চা হয় না বলে। ওকে আনার পরই তোমার বড় সন্তানের জন্ম হলো। আমার বোন মারা যাওয়ার সময় তার হাত ধরে কথা দিয়েছিলে তুমি তাকে দেখে রাখবে। এই তোমার দেখার নমুনা। আর খুকী হওয়ার সময় তোমার মরমর অবস্থা। বসন্ত না থাকলে খুকীকে কে রাখতো বলতো? তোমার বাপের বাড়ির মানুষও তো আসেনি। তোমার এত সব কাজ কে করে দিতো বলতো? বলদের মত তুমি সারাদিন ওকে খাটাও।  শুধু শুধু নিজের মায়ের কথা শুনে অমন ভালো ছেলেটার সাথে এমন করো। ওপারে গিয়ে কি জবাব দেবে তুমি ভেবে দেখেছো? 

কথা গুলো চাঁপা বেগমের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। মনে মনে বলে, আসলেই তো মায়ের কথা শুনে আমি এমন কেন করছি? বসন্তকে আনার পরই তো আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেলাম। আর আমার খুকি! বসন্ত না থাকলে খুকি তো তখনি.....

তবুও তার মায়ের বলা কথা গুলো মনে হয়ে যায়। মনে রাগ এনে বলে, শুনো আমাকে কিছু বোঝাতে আসবে না। আমার মা আমাকে কিছু বোঝায়নি। তোমার ঐ রোগ বালাই ভাগ্নের পেছনে আর টাকা খরচা করতে পারব না। টাকা কি গাছে ধরে?

খুকি বলে, আচ্ছা মা বড় ভাইয়ার নাম বসন্তের মানে যদি গুটি বসন্ত, জলবসন্ত হয়, তাহলে তো তোমার নামের মানেও চাঁপাফুল না চাপাখুর। 

খুকির কথা শুনে বসন্তের মামা ফিক করে হেসে দেয়। চাঁপা বেগম হকচকিয়ে যায়। এই কথার প্রতিউত্তর না পেয়ে মুখ ফুলিয়ে চলে যায়। তারপর বাবা আর মেয়ে মিলে হাসাহাসিতে মেতে উঠে।

#চলবে,,,,,

#পর্ব_১

#বসন্তের_রঙে

#মুনমুন_কাঁকন

꧁ 𝐸𝓀 𝐵𝑒𝓁𝒶𝓇 𝐿𝒾𝓅𝒾𝓀𝒶 ꧂