বসন্তের রঙে ৩

#বসন্তের_রঙে

#পর্ব_৩ ও শেষ পর্ব

#মুনমুন_কাঁকন

বসন্ত মামার ঠিক করা হোস্টেলে গিয়ে উঠে। আসার সময় সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। এ জীবনে কত কিছুই না সইতে হচ্ছে তাকে। হোস্টেলের সবাই অনেক ভালো। কিন্তু কিছুতেই তার মন টিকছে না। খুকি আর মামার কথা খুব করে মনে পরে তার। ঐ দিকে খুকি তার মামার বাড়ি থেকে এসে দেখে বসন্ত নেই। সব ঘটনা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বসন্তের মামা লুকিয়ে মাঝে মাঝে ফোন দেয়। সেই সময় খুকির সাথে ও তার কথা হয়। খুকি কান্না করে চলে আসতে বলে। 

এভাবেই বসন্তের দিন কাটতে থাকে। আর আসায় থাকে কবে বসন্তের মত তার জীবনটাও রঙিয়ে উঠবে। এর মাঝে তার ইন্টার পরীক্ষা হয়ে রেজাল্ট ও বের হলো। জিপিএ ৫ পেয়েছে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সও পেয়েছে। এখন আর আগের মত কাঁদে না। মামা আর খুকির সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। খুকি এটা ওটা আনতে বলে তাকে। মামা চাঁপা বেগমকে লুকিয়ে তাকে টাকা পাঠায়। সেও টিউশনি করে। এভাবেই খরচ চলে যায়। বাড়িতে যেতে পারে না। যাওয়ার জন্য মনটা যখন খুব কেমন করে উঠে, তখনি মামীর বলা কথা গুলো মনে পড়ে যায়। বসন্তের মামা হাজার চেষ্টা করে চাঁপা বেগমের মন নরম করতে পারেনি। যার ফলে বসন্তের বাড়ি যাওয়াও আর হয় না। কলেজ ছুটি হলে কলেজের যে দারোয়ান মামা আছে তার বাড়িতে গিয়ে থাকে বসন্ত। দারোয়ান মামা একাই থাকে। বিয়ে সাদি কিছু করেনি। তাই বসন্তের মত সঙ্গী পেয়ে তারও ভালোই লাগে।

এভাবেই কেটে যায় নয়টি বছর। বসন্ত এখন প্রশাসন ক্যাডার। এখন আর কোনো কষ্ট তার নেই। কিন্তু মামা আর খুকির কথা খুব মনে পরে। খুকি নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে। কেমন দেখতে হয়েছে খুকি? এসব প্রশ্নই তার মনে উঁকি দেয়। এখন আর আগের মত মামা ফোন দেয় না। খুকিও অনেক আগেই থেকেই কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। এখন আর কথাই বলে না। মামার নাম্বারে ফোন দিলে রিং হয় কিন্তু ধরে না। আর ধরলেও ১/২ মিনিটের বেশি কথা বলতে চায় না। এটা ওটা বাহানা দিয়ে ফোন রেখে দেয়। বসন্ত সবই বুঝতে পারে। খুব ইচ্ছে ছিল চাকরি হওয়ার পর সে মামা আর খুকিকে তার এখানে আনবে। খুকির কত আবদার! সব সে পূরণ করবে। কিন্তু তারা তো তার সাথে যোগাযোগই বন্ধ করে দিতে চাইছে।

একদিন ভাবল মামার বাড়ি গেলে কেমন হয়। কতদিন আগের কথা এখন নিশ্চয়ই আর মামীর রাগ নেই। আর থাকলেও সে মানিয়ে নেবে। তাই একদিন হুট করেই মামার বাড়ি গিয়ে হাজির। গিয়ে দেখে এক মধ্য বয়সী মহিলা বাসন মাজছে। ভাবে বাড়ির কাজের লোক হয়ত। কিন্তু একি! কাছে গিয়ে দেখে তার মামী। কি হাল হয়েছে তার মামীর। আর পড়নের শাড়ির কি অবস্থা। বসন্তকে চাঁপা বেগমের প্রথমে চিনতে অসুবিধা হয়। কিন্তু যখনই বসন্ত মামী বলে ডাক দেয় তখনই চাঁপা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে  কাঁদতে শুরু করে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবা আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস। তোর উপর অন্যায়ের শাস্তি আমি পাচ্ছি। তোর মামা আমাকে অনেক বার বলেছে তোর সাথে কথা বলতে। কিন্তু লজ্জায়, অনুশোচনায় আমি পারিনি। আর তুই এখানে কেন আসতে গেলি? তোর মামাকে তো বলেছিলাম তোকে যেন এখানে না আনে।

বসন্ত তার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারে না। তখন তার মামা এসে বলে, তুই না বলে আসতে গেলি কেন? 

বসন্ত বলে, এই অবস্থা কেন তোমাদের? আর মামী এসব কি বলছে? কাঁদছেই বা কেন? খুকি কোথায়?

তার মামা বলে, সবই আমাদের পোড়া কঁপালরে বাবা। তুই কষ্ট পাবি বলে তোকে কিছু জানাইনি। ভেবেছিলাম তোকে কখনও এসব জানতেও দেবো না। কিন্তু তুই যখন সব দেখেই ফেলেছিস তখন আর কিভাবে লুকাব। আকাশ বিয়ে করার পর থেকে সে আর তার বউ আমাদের কাজের লোকের মত খাটায়। জানিসই তো ওর চরিত্র কেমন ছিল। আর সাগর তার কথা আর কিইবা বলব। আকাশের ভাগের জমি বাদে বাকি সব জমি বেঁচে তাকে বিদেশ পাঠালাম। আর সে সেই যে গেল আর কোনো খোঁজ মিলল না। আমরা ভেবেছিলাম তার হয়ত কিছু হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখি সে সুখেই আছে। মাঝখান থেকে আমার একমাত্র মেয়ের শেষ সম্বলটা শেষ করে দিলাম। আকাশ আমাদের সাথে যাই করুক মুখ বুজে মেনে নেই। কিন্তু তুই তো জানিস খুকি আমাদের কত আদরের। আমার মেয়েটাকে পর্যন্ত ওরা খেতে পড়তে দেয় না। সাগরকে সব উজার করে দিয়ে খুকির ভবিষ্যতটাও নষ্ট করলাম। এই নিয়ে উঠতে বসতে আকাশ আর তার বউ কথা শুনায়।

 এই বলে, তার মামা ও চাঁপা বেগম কান্নায় ভেঙে পরে। বসন্ত সব কথা শুনে হতবাক। এত কিছু ঘটে গেল। আর সে কিছুই জানতে পারল না। তখনি দৌড়ে খুকি আসে। বসন্ত দেখে কি সুন্দর হয়েছে খুকি। একদম পরীর মতো। কিন্তু তার অবস্থা দেখে বুক মোচড় দিয়ে উঠল। তখনি আকাশের বউ এসে বলে, বলি হচ্ছে কি? কাজকর্ম কে করবে? বসে বসে খালি আমার অন্য গেলা। আপনাকে না বলেছি বাজার করে আনতে। এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? 

বসন্ত কিছু না বলে, তিনজনকে হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা তার বাড়িতে চলে আসে।

কিছুদিন পর---- 

সবার জীবনেই বসন্ত এলো। চাঁপা বেগম তার ভুল অনেকদিন আগেই বুঝতে পেরেছিল। এখন সে মায়ের স্নেহে বসন্তকে আগলে রাখে। অবশেষে সে, তার স্বামী ও মেয়ে অসীম দুঃখ থেকে মুক্তি পেল। বসন্ত ও তার মা বাবার আসনে বসানো মামা মামীর ভালোবাসা পেল। বসন্তের রঙ সবার জীবনই রাঙিয়ে দিল। সন্ধ্যায় বসন্ত বেলকনিতে বসে আছে। তার মামী তাকে চা খেতে দিয়ে বলে, হ্যাঁ রে বাবা ও বাড়ি থেকে আমাদের জিনিস গুলো নিয়ে আসলে ভালো হয় না? 

ও বাড়িতে কি আছে তোমাদের যে আনবে? 

চাঁপা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে, হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। কিইবা আছে আনার? এখনতো কিছুই আমার না। এই বলে চলে যায়। 

তখনি খুকি আসে। ঘন কালো চুল, টানা টানা চোখের মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেছে। খুকি বসন্তকে দেখে লজ্জা পায়। বসন্তের সামনে খুব একটা আসে না। আর কথা বললেও খুব কম বলে। বসন্তও তা বুঝতে পারে। বসন্ত বলে, খুকি তোর মনে আছে ছোট বেলায় তুই আমার কাছে কি কি আবদার করতি? আমি কিন্তু সব মনে রেখে কিনে রেখেছি। 

হুম মনে আছে। কিন্তু ঐসব দিয়ে এখন আমি কি করব?

খেলা করবি আর আমি দেখব। ছোট বেলায় মামীর বকুনিতে তোর খেলা তো দেখতেই পারতাম না। তাই ঠিক করেছি এখন দেখব।

খুকি লজ্জা পেয়ে আর কোনো কথা বলে না।

বসন্ত খুকির দিকে তাকিয়ে ভাবে, কি সুন্দর দেখতে হয়েছে খুকি একদম বসন্তের ফুলের মত। আর কত লাজুক হয়ে গেছে। খুকিকে বিয়ে করলে মন্দ হয় না তাই না? নিজের মনকেই প্রশ্ন করে আর মুচকি হাসে।

বসন্ত মুচকি হেসে বলে, আচ্ছা খুকি তোর ভালো নাম যেন কি? 

কুহু। 

কুহু তো কোকিল ডাকে বসন্তকালে তাই না? 

সেই ছোট বেলার কথা মনে করে খুকি হেসে দেয়। অতঃপর বসন্ত খুকির দিকে একটা চিরকুট ছুড়ে দেয়। তাতে লেখা.....

" খুকি আমার বউ হবি? বউ হলে অনেক গুলো খেলনা কিনে দেবো। তুই খেলবি আর আমি দেখব।"

..........সমাপ্ত.......

꧁ 𝐸𝓀 𝐵𝑒𝓁𝒶𝓇 𝐿𝒾𝓅𝒾𝓀𝒶 ꧂