বসন্তের_রঙে ২

#বসন্তের_রঙে

#পর্ব_২

#মুনমুন_কাঁকন

এভাবেই দুঃখে কষ্টে কাটে বসন্তের দিন। সামনে তার ইন্টার পরীক্ষা। কিন্তু মামী তাকে পড়ার সময়ই দেয় না। পড়ার ফাঁকে পাশের বাড়ির ২ জন ছেলেকে পড়ায়। তা থেকে অর্ধেক মামীকে দিতে হয়। বাকিটা দিয়ে খুব হিসেব করে মাস গুলো পার করে। এসবের ফাঁকে আবার খুকিকে পড়াতে হয়। তার পড়ার সময়ই বা কোথায়। রাতের বেলা পড়ছে এমন সময় খুকি যায় বসন্তের ঘরে। বসন্তের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, বড় ভাইয়া কোকিল কুহু কুহু করে কখন ডাকে?

বসন্ত মুচকি হেসে ঘাড় ঘুড়িয়ে বলে, বসন্ত কালে। এখন যা গিয়ে পড়তে বস। আর আমাকেও পড়তে দে। 

তোমার চাকরি হলে আমি যা চাইব তাই দিতে হবে কিন্তু। 

আচ্ছা আচ্ছা দেবো কোকিল পাখি আমার। এখন যান এখান থেকে। না পড়লে চাকরি পাব কিভাবে শুনি?

খুকি মুচকি হেসে হেলেদুলে বসন্তের ঘর থেকে চলে যায়। তার কিছু দিন পর বসন্তের মামা কয়দিনের জন্য দেশের বাড়ি যায়। বাজার করা থেকে বাহিরের সব কাজের দায়িত্ব থাকে বসন্তের উপর। বাজার থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় চাঁপা বেগম আবার বকা বাদ্য শুরু করল,

এত দেরি হলো যে? বাজারে গেলে আসতেই মন চায় না তোর তাই না? নিশ্চয়ই ও পাড়ার নেশাখোরদের সাথে নেশা করিস। না হলে এত দেরি কেন হয় তোর? আপদ তোর বাবা মা তো তোর জন্য এক গাদা টাকা রেখে যায় নি। বসে বসে আমরা অন্য ধ্বংস করছে। 

পাশ থেকে তার মেজো ছেলে সাগর বলে, তাহলেই বোঝো মা, যে বড় ভাইয়া নেশা কি করবে?

মানে? 

মানে তার বাবা মা যেহেতু তার জন্য টাকা রেখে যায় নি। আর তুমি ও তাকে কোনো টাকা পয়সা দাও না। তাহলে নেশার জিনিস কিনতে যে টাকা লাগে সে টাকা পাবে কোথায়? নেশা করে তোমার বড় ছেলে আকাশ। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখ। 

সাগরের কথা শুনে বসন্ত ও চাঁপা বেগম দুজনেই হতবাক হয়ে যায়। বসন্ত আগেভাগেই বলতে থাকে, আমি কিছু জানি না মামী। আকাশ আমায় কিছুই বলে না। 

রাতের বেলা লাল চোখ নিয়ে আকাশ বাড়ি ফিরে। চাঁপা বেগম তার চোখ দেখেই বুঝে যায়। সাগরের কথা মিথ্যা না। এত দিন সে কেন ছেলের প্রতি নজর দেয়নি? তার কারণ ছেলের প্রতি তার অন্ধবিশ্বাস নয়ত?

সেদিন রাতে আকাশকে ইচ্ছে মত মারধর করে। আকাশের বাবা ফিরে আসলে তাকে কঠিন পাহাড়ায় রাখা হয়। হাত খরচা, দরকার ছাড়া বাহিরে বের হওয়া সব বন্ধ করে দেয়। চাঁপা বেগম সবই তার কঁপালের দোষ বলে বিলাপ করতে থাকে। এই বয়সে তার ছেলেটাই কেন বিপথে গেল!

একদিন চাঁপা বেগম সাগরকে পড়াতে পড়াতে বলে, একদিন অনেক বড় হবি তুই। আর তারপর আমাকে, তোর বাবাকে আর খুকিকে দেখবি। 

সাগর হালকা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে, হুহ তোমাদেরকে আমি কেন দেখবো? আমি বিদেশ যাবো। ঐখানে গিয়ে বড় বাড়ি আর গাড়ি কিনবো। আর সারাক্ষণ মস্তি করবো। আর খুকিকে আমি কেন দেখবো? খুকিকে দেখার দায়িত্ব কি আমার? 

ওমা ও কি কথা! খুকি না তোর বোন হয়? 

বোন হয়েছে তো কি হয়েছে? আমি কাউকে দেখতে-টেখতে পারব না। বড় ভাইয়া তোমাদের দেখবে বুঝেছো?

এই বলে সাগর চলে যায়। ছেলের কথা শুনে চাঁপা বেগম তাজ্জব হয়ে যায়। আর তার চেয়েও বেশি কষ্ট পায়। চোখের কোণে পানি চলে আসে। যে ছেলে এখনি এসব বলে, সে বড় হয়ে কি করবে? তার দুই ছেলে এমন কেন হলো? একটা নেশা করে আরেকটা.... 

এসব ভেবে চোখ থেকে অশ্রু বিসর্জন দেয়। পাশেই বসন্ত বসেছিল। সে চাঁপা বেগমের কাছে গিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, সাগরের কথায় তুমি কষ্ট পেও না মামী। ছেলে মানুষ তাই না বুঝে বলেছে। আর সাগর তো ঠিকই বলেছে আমি বড়। এসব দায়িত্ব তো আমারই। দেখো মামী একদিন তোমাকে, মামাকে আর খুকিকে নিয়ে অনেক বড় বাড়িতে থাকব। তোমাকে আর মামাকে কোন কষ্ট করতে দেবো না। মিলিয়ে নিও তুমি। 

বসন্তের কথা শুনে চাঁপা বেগমের বুক হুহু করে উঠে। তখনি তার স্বামীর ডাক শুনে চোখ মুছে চলে যায়। বসন্ত ও পড়তে বসে। এভাবেই কাটতে থাকে দিন।

বসন্তের পরীক্ষা শেষ। শত ঝামেলার পরেও যে তার পরীক্ষা ভালো হয়েছে এটাই অনেক। আর মনে মনে ভাবে পরীক্ষা ভালো হলেই কি মামী কি তাকে ভর্তি কোচিং করতে দেবে? এ নিয়ে তার মামার সাথে কথা হয়েছে। মামা বলেছে কোন না কোনো ভাবে ব্যবস্থা করবেই। এরই মধ্যে আকাশের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। তার ২ সাবজেক্টে ফেল এসেছে। চাঁপা বেগম আর তার স্বামীর মাথায় হাত। আশেপাশের লোকজনকে কি ভাবে মুখ দেখাবে? আর এত দিন যে পড়ার জন্য হাজার হাজার  টাকা খরচ করল এগুলো কোথায় করল?

চাঁপা বেগম কাঁদতে কাঁদতে তার স্বামীকে বলে, ফেল করবে না তো কি করবে? দেখ গিয়ে বেতনের টাকা দিয়ে ও নেশা করে বেড়াত। 

করবে না তো কি করবে? তুমি ওকে কখনও শাসন করেছে। যা চেয়েছে তাই দিয়েছ। কখনও জিজ্ঞেস করনি কেন চাইছে। তোমার জন্য ছেলেটা উচ্ছনে গেছে। 

সারাদিন আকাশকে নিয়ে বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকে। এরই মধ্যে বসন্তের ভর্তি কোচিং এর সময় হয়ে যায়। চাঁপা বেগম কিছুতেই বসন্তকে আর পড়তে দেবে না। নিজের ছেলে ফেল করেছে বলে সেই ঝাল মেটায় বসন্তের সাথে। চাঁপা বেগম তার স্বামীকে বলে, পরের ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে টাকা নষ্ট করতে পারব না। নিজের ছেলেকে যেখানে মানুষ করতে পারলাম না অন্যের ছেলে হুহ। 

টাকা নষ্টে কথাই যখন উঠছে তাহলে শোনো বসন্তের মা মানে আমার ছোট বোনের জমির টাকা দিয়েই কিন্তু আমাদের সবার খোরাক আসে। সেই টাকা দিয়েই বসন্তের পড়াশোনা চলবে। আজ কতগুলো বছর ধরে ওর টাকায় খাচ্ছো পড়ছ সেই হিসেবটা কি করেছ? আর ওর তো ১৮ বছর হয়ে গেছে হিসাব অনুযায়ী তার মায়ের সব এখন তার হওয়ার কথা। কি ব্যাপার এখন চুপ করে আছো যে? 

এবার চাঁপা বেগম তার স্বামীর সাথে আর চাপা করে পারল না। কারণ তার স্বামীর বলা প্রত্যেকটা কথাই সত্যি। কথার উত্তর না পেয়ে চাঁপা বেগম চলে যায়। আড়াল থেকে তাদের সব কথা শুনছিল বসন্ত। আর কথা গুলো এমন জোরে বলছিল সে না চাইলেও তাকে শুনতে হত। মামা বসন্তের কাছে আসলে বলে, মামা ওসব জমি আমার লাগবে না। তোমরা তো আমার বাবা মা। বাবা মা থাকতে কি সন্তান জমি নিয়ে যায়?

বসন্তের মামা হু হু করে কেঁদে বলে, আমাকে আর লজ্জা দিস না বাপ। তোর জন্য এ জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। তবে চিন্তা করিস না। তোকে আমি শহরে পাঠাব। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবি তুই। শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। আর তোর মামার প্রতি একটু বিশ্বাস রাখবি। 

বসন্ত নিরুপায়। এত অল্প বয়সে এত কঠিন পরিস্থিতিতে মনে হয় কেউ পরে না। দুই দিন পর বসন্তের যাওয়ার তারিখ হলো। কিছু করতে না পেরে চাঁপা বেগম বলে, বসন্ত যদি আজ চলে যায়, তাহলে আর জীবনেও এ বাড়িতে আসতে পারবে না। এ বাড়ির দরজা তার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। আর যদি আসে তাহলে আমি আমার তিন সন্তান নিয়ে গলায় দড়ি দেব।

বসন্তের মামা বলে, বাহ্ ভালোই চাল চেলেছ। শেষে কিছু করতে না পেরে এই ফন্দি আঁটলে। এটা বসন্তের মামার বাড়ি ও যখন খুশি তখন আসবে। 

আচ্ছা তাই নাকি? শোন বসন্ত যদি আর কোনোদিন এ বাড়ি মুখো হোস শুনে রাখ তুই আমার ম*রা মুখ দেখবি।

সব কান্ড দেখে বসন্ত হতবাক। গলায় জোর দেখালেও বসন্তের মামা ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে। বসন্তকে বলে, যা বাবা যা। তোর আর তোর মায়ের স্বপ্ন পূরণ কর গিয়ে। আসতে হবে না এখানে। তোর মামা যতদিন আছে তোর কোনো চিন্তা নেই। যা যা বাবা চলে যা....

"খুকিরে চলে যাওয়ার আগে তোকে শেষবার দেখে যেতে পারলাম না। জানি না আবার কবে দেখব তোকে। দোয়া করিস আমার জন্য। আর নিজের যত্ন নিস। পড়াশোনা করতে ভুলবিনা কিন্তু। 

আমার বসন্তের কোকিল।"

খুকির বইয়ের ভেতর এই চিরকুটটা রেখে বসন্ত রওয়ানা হল তার নতুন গন্তব্যে।

চলবে,,,,,,

꧁ 𝐸𝓀 𝐵𝑒𝓁𝒶𝓇 𝐿𝒾𝓅𝒾𝓀𝒶 ꧂