একটি গোলাপের আত্মহুতী

জন্ম আমার বারো বছর আগে। এক কৃষকের গোলাপ ক্ষেতে বর্ষার কোনো এক দিনে হয়ে ছিলাম আমি। সেদিন সূর্য ওঠেনি, মুখ তুলতেই কয়েক ফোঁটা বর্ষার পানি মুখের উপর পড়লো তীরের গতিতে। মৃদু বাতাসে সদ্য ফোটা অনেকই দুলছিলাম। এরপর একজন লোক এসে একটা ধারালো ছুরি দিয়ে আমাকে গাছ থেকে আলাদা করে ফেলল। আমি খুব ব্যথা পেয়ে মা মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। সে কান্নার আওয়াজ হয়তো কৃষক শুনতে পায়নি। তবে অজ্ঞান হতে হতে মায়ের যে কথা ভেসে এসেছিল তা হল, "কাঁদিসনে বাবা, তোর আগে অনেকই জন্ম নিয়েছে, কাউকে ধরে রাখতে পারি নি আমি। আমাদের জন্মই হয় মানুষকে শুভেচ্ছা জানাতে"।

জ্ঞান ফিরল এক ফুলের দোকানে। চোখ মেলে দেখলাম অনেক গোলাপের সাথে দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল।

একজন বললো যাহোক বাসর ঘরের সাজ হলে খুব এনজয় করব।

নারে আমাকে যদি রাজনৈতিক নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে দেওয়া হয় তবে বেশ খুশি হব।

এর মধ্যে বিয়ে বাড়ি থেকে কিছু ফুল নিতে এক লোক আসলো। কিছু গোলাপ, গাদা ও রজনীগন্ধার

সাথে আমাকেও নিয়ে চললো।

বাড়িতে গিয়ে খুব যত্ন করে রাখা হলো আমাদের। আমি তখন খুব উত্তেজিত কারণ বাসর ঘরের সাজ হব বলে।

হঠাৎ এক তরুণীর হাতের স্পর্শে চেতনা ফেরে। সে আমাকে হতে নিয়ে ঘ্রাণ নিল আর সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো।

হায়! আমার বাসর ঘরের সাজ হওয়া আর হল না। বাইরে প্রচুর লোকের চেঁচামেচি, গান ইত্যাদি। আমার জীবন যে এরকম আফসোসের সাক্ষী হয়ে থাকবে তা তখনও বুঝতে পারিনি।

এদিকে অনেকক্ষণ যাবৎ পানি না পাওয়ায় আমার সাথে থাকা পাতা গুলো নেতিয়ে পরেছে। পাপড়ি গুলোর কিনারা হালকা কালো বর্ন ধারণ করেছে।

এমন সময় তরুণী এক তরুণের সামনে গিয়ে আমাকে একটা চুমু খেল। তারপর আমাকে ধরে রাখা হাতটি তরুণের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো "আমোরে"। সে তরুণ ও খুব খুশি মুখে বলল "আমোরে"। যদিও আমি তার অর্থ বুঝলাম না। তবে তরুণের চকচকে চোখ আর মুচকি হাসি দেখে বুঝলাম ভালো কিছু ছিল। পরে অবশ্য জানলাম "আমোরে" অর্থ "আমি তোমাকে ভালবাসি"।

ছেলেটি আমায় নিয়ে একটা চুমু খেয়ে, ঘ্রাণ নিয়ে ওর বুক পকেটে রাখলো।

ওর হৃদপিন্ডের ঢিবঢিব শুনতে পেলাম, যা আমাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। একটানা দুই দিন ওর ওই বুক পকেটে থেকে, এখানে সেখানে ঘুরেও সেদিন বুঝতে পারিনি পরবর্তী কয়েক বছর ওর সাথেই থাকতে হবে আমার, ওর অনেক কিছুর প্রমাণ হয়ে।

গত চারদিন ছেলেটি আমাকে কয়েক বার ওর পকেট থেকে বের করে চেয়ে থেকে মুচকি হেসেছে আর চুমু খেয়ে আবার পকেটে রেখে দিয়েছে। অবশ্য জামা ও পকেট বদল হয়েছে কয়েক বার।

আমার অবস্থা যাচ্ছেতাই। শুকিয়ে নেতিয়ে পড়েছি। পাপড়ী গুলো কেমন কালো খয়েরি রং ধারণ করেছে।

এবার ছেলেটি আমাকে একটা খোলা ডায়েরির উপর রাখলো। ডায়েরির পাতাগুলো ছোপ ছোপ রক্তের কি সব আঁকিবুকি ও লেখায় ভরা ছিল। তারপর আমাকে ডায়েরির মধ্যে রেখে বন্ধ করে দিলো।

এক সপ্তাহ কেটে গেলো। আমি পুরোপুরি শুকিয়ে গেছি। পুরো দেহটি চ্যাপ্টা হয়ে একটা পাতার মতো হয়ে গেছে।

শরীর থেকে কেমন তামাকের গন্ধ আসছে। মনটা খারাপ লাগছে। একটা ডায়েরির মধ্যে সেরা ফুল শুকিয়ে পরে থাকলে মন খারাপ হওয়ারই কথা। এমন সময় তরুণের হাতের ছোঁয়াতে কেঁপে উঠলাম।

আমাকে ধরে ডায়েরিটি বন্ধ করে দিলো। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ আমাকে দেখলো, চুমু খেলো ও ঘ্রাণ নিলো।

তারপর আমাকে ওর মানি ব্যাগ এর একটা চেম্বার এ রাখলো। সেখানে রাখতে গিয়ে আমার শুকনো পাতার এক কোনা ছিড়ে গেলো। তরুণ আহ্ শব্দে আঁতকে উঠলো।

এবার মানি ব্যাগ যখনই বন্ধ করতে যাবে তখনই দেখলাম মুখোমুখি চেম্বার এ সেই তরুণীর ছোট্ট একটা ছবি। ও ঘটনা তবে এই!

এরপর প্রতি রাতে যখন সবদিক নির্জন হয়, কলহ থেমে যায় তখন তরুণ তার মানি ব্যাগ খোলে। আমাদের (আমি ও ছবি)সাথে কথা বলে। সে কত কথা, I love you, তুমি শুধুই আমার, তোমার কোন কিছুই আমি হারাতে চাইনা ইত্যাদি। এভাবে কেটে গেলো ছয়টি বছর। তরুণীর সাথে কয়েকবার দেখাও হয়েছিল। তরুণ - তরুণীকে, আমাকে দেখিয়ে বলেছিলো, 'দেখতো চিনতে পারো কিনা'! তরুণী আমায় অনায়াসে চিনতে পারে।

হঠাৎ একদিন বরাবরের মত মানি ব্যাগ খুলে গেলো, আমি একটু বিরক্ত ছিলাম, প্রতিদিন এই ভালোবাসার প্যানপ্যানানি আর ডজন খানেক চুমু আর ভালো লাগছিল না।

সত্যি ও নতুন কিছু নিয়ে এলো আমার জন্য। ওর চোখে জল। মুখে বিষাদের চিহ্ন, যা আমি আগে কখনো দেখিনি। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ওর বুকের কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে, সেখান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

ছবির দিকে তাকিয়ে বলছে তুমি এমন করতে পারো না। যে প্রতিদিন ভালোবাসার কথা বলে রাতে ঘুমাতে যায়, সে আজ রক্তাক্ত অবস্থায় কান্নাকাটি করছে। আমাদের খুব খারাপ লাগলো। ওর সাথে ছবি ও আমি দুজনেই কাঁদছি।

এভাবে কান্নার সঙ্গী হলাম 2 7 দিন। তরুণের মুখ শুকিয়ে গেছে। আজ ওর সাথে আমার শেষ দিন। ঘরে কেউ নেই, মেঝেতে এক কোণে বসে তরুণ তার মানি ব্যাগ খুলল। চোখ মুখ ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। আমাদের দেখে তার কান্না বিলাপে পরিণত হল। খুব জোরে কান্না করলো অনেকক্ষণ। তারপর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম আর তুমি কি না ধোকা দিয়ে চলে গেলে!

এই বলে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল মানি ব্যাগ সহ আমাদের। কান্না করতে করতে মানি ব্যাগের সাথেই পড়লাম মাটিতে আছড়ে।

আজ মে মাসের 12 তারিখ। 6 বছর আগে ঘটেছিল এসব ঘটনা। তরুণের দেখা পাইনি আর কোনোদিন। সেই মানি ব্যাগ এর প্লাস্টিক চেম্বার এ পরে আছি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে। হয়তো মাটির এক ফুট নীচে। ছবি টি অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি অতৃপ্ত হয়ে পড়ে আছি, তরুণের অসমাপ্ত জীবনের গল্প জানতে। আশা করি ও যেন ভালো থাকে। সত্যই আমি ধন্য, সব গোলাপের এমন ভাগ্য হয় না............

𝐸𝓀 𝐵𝑒𝓁𝒶𝓇 𝐿𝒾𝓅𝒾𝓀𝒶 ☑